বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধের উস্কানি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জুলাইয়েও মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। 2017 সালের আগস্টে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর, মিয়ানমারের হেলিকপ্টার অন্তত তিনবার বাংলাদেশের আকাশসীমার উপর দিয়ে উড়েছিল। এরপরও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়।
কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে ‘যুদ্ধের উসকানি’ দিয়ে আসছে মিয়ানমার। গত শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে জিরো লাইনের কাছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ১২০ মিটার ভেতরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি শেল আসে। জনবসতিহীন পাহাড়ে দুটি গোলা বিস্ফোরিত হলেও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগে ২৮ আগস্ট নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তরে ঘুমধুমপাড়ার জনবহুল এলাকায় দুটি মর্টার শেল পড়ে। তবে দুটি শেল বিস্ফোরিত না হওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরদিন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল তা নিষ্ক্রিয় করে দেয়। দুই দিন পর ৩০ আগস্ট মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের জানান, ওই দিন দুপুরে ঘুমধুম ইউনিয়নের বৈশফান্ডারী সীমান্তের ৩-৪০০ গজের মধ্যে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টারকে কয়েকবার ঘুরতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জুলাইয়েও মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। 2017 সালের আগস্টে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর, মিয়ানমারের হেলিকপ্টারগুলো অন্তত তিনবার বাংলাদেশের আকাশসীমার ওপর দিয়ে উড়েছিল। এরপরও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়।
এবারও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মর্টার শেল ও বুলেট নিক্ষেপ এবং মিয়ানমারের হেলিকপ্টার কর্তৃক বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সতর্ক করা হয়েছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার বলেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কূটনৈতিক মহলকে জানানো এবং মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকাতে সরকার পরিকল্পনা করছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা মিয়ানমারের উস্কানি বা ফাঁদে পা দিতে চাই না।
2017 সালের অক্টোবরে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন যে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের প্ররোচনা এড়াতে সতর্ক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী, একপর্যায়ে এমন মনোভাব দেখালেন; আমাদের সাথে যুদ্ধ হবে, সেরকম কিছু। আমি আমাদের সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী, পুলিশকে সতর্ক করে দিয়েছি যে, কোনো ধরনের উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হতে। যতক্ষণ না আমি নির্দেশ দিচ্ছি।’
প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার কেন বাংলাদেশের সীমান্তে মর্টার শেল ও গুলি ছুড়ছে এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে?
জানা গেছে, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই চলছে। বিশেষ করে রেজু আমতলী সীমান্তের কাছে ওয়ালিডং পাহাড়ে প্রায়ই গোলাগুলি হচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় জুমচাষীরা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভয়ে জুমকাজে যেতেও পারে না।
তবে একটাই কারণ আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই নাকি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির একটা হিসেবও আছে, সেটাও ভাবা দরকার এবং এমন উস্কানিতে বাংলাদেশের কৌশল বা কৌশল কী হবে; মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা কি প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকবে?
বাংলাদেশের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ 25) রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং জাতিসংঘের সনদ – এই নীতিগুলি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি হবে। ‘
জবাবে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেল ও গুলি নাও ছুড়তে পারে, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হতে হবে ভিন্ন। যারা বাংলাদেশের বন্ধু তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি উত্থাপন করা এবং নিছক আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ না জানিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।
এ অঞ্চলে ভারত ও চীনের আধিপত্য বিস্তারের কৌশলে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই দুটি দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এবং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের সমুদ্র। যে কারণে বাংলাদেশ চীনের কাছাকাছি গেলে ভারত ক্ষুব্ধ হয়। আবার বাংলাদেশ ভারতের কাছাকাছি গেলে চিন বিচলিত হয়।
যেহেতু এই অঞ্চলে চীনের বড় বন্ধু মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক জটিলতা রয়েছে; চীনের প্রশ্রয়ের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বের কাউকে পাত্তা না দেওয়ার মানসিকতা মিয়ানমারের রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে এবং যেহেতু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে, সেহেতু এই সমীকরণগুলোও কি না সেটাও ভাবতে হবে। বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধের প্ররোচনার পেছনে ভূমিকা পালন করছে।
মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ থেকে গোলাবর্ষণ করছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছে ঢাকা। আসলে চিন্তা করার কিছু আছে কি? এ ধরনের ঘটনার জন্য মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বারবার তলব করে কঠোর প্রতিবাদ জানানো উচিত।
বিষয়টি আঞ্চলিক ফোরামে তোলা দরকার। দিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। মিয়ানমারের সঙ্গে দিল্লির সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এটা উত্থাপন করা দরকার। এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদেও এ নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলাদেশকে উস্কে দিতে চায় মিয়ানমার। না বোঝার কোনো কারণ নেই। তারা বাংলাদেশকে সংঘাতে জড়াতে চায়। তবে বাংলাদেশকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। সংঘাতের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে আনতে চায় মিয়ানমার। তবে সংঘাতের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান হবে না। সংকট আরও বাড়বে।
হয়তো তারা বিষয়টিকে জটিল করতে চায় যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আরও বিলম্বিত হয়। তারা যদি বাংলাদেশকে সংঘাত বা সামরিক অ্যাকশন দিয়ে অশান্ত করতে পারে তাহলে তারা সুবিধা দেখতে পায়। সেজন্য বাংলাদেশের উচিত যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে আসা। এটা করা গেলে মিয়ানমারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হবে।
গত কয়েক বছরের মিয়ানমারের আচরণ থেকে আমাদের বুঝতে হবে যে তারা বাংলাদেশকে সংঘাতে জড়াতে চায়। তবে বাংলাদেশকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। সংঘাতের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে আনতে চায় মিয়ানমার। তবে সংঘাতের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান হবে না। সংকট আরও বাড়বে। বাংলাদেশকে শত্রু বানাতে চড়াই-উতরাই লেগেছে। এজন্য আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিশ্বে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। প্রচুর ব্যবসা চলছে। গণহত্যাকারী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা যায় না। মায়ানমারের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের কী সম্পর্ক, তা ভাবতে হবে? এটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
সেজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ শুরু থেকেই শান্ত।
বাংলাদেশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ শুরুতে ঠিক ছিল না। আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের সাথে যোগাযোগ করেছি। গণহত্যার বিষয়টি আমরা বড় আকারে আনতে পারিনি। আমরা এটা আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরতে পারতাম। আমরা দুই মাসের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছি, যেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো সময়সীমা ছিল না।
মিয়ানমারের চেয়ে হাজার গুণ বেশি বন্ধু রয়েছে বাংলাদেশের। এ কারণে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তন করে কথা বলা যৌক্তিক ছিল। এই পরিস্থিতিতে আমরা সত্যিই চুপ থাকতে পারি না। মায়ানমার যা করছে তা সম্পূর্ণ ভুল।
মিয়ানমার যুদ্ধ চায় কিন্তু বাংলাদেশ চায় না। এটা বিশ্ববাসীকে বুঝতে হবে। যুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। কূটনৈতিক আলোচনার কোনো বিকল্প হতে পারে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। সবাই কষ্ট পায়। তবে শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। কিন্তু এই আলোচনা আগে করা যাবে না।
মিয়ানমার এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলে সকাল-বিকাল রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হবে। তবে তা বিশ্ব ফোরামে তুলে ধরা দরকার। কারণ মিয়ানমার ছোট ঘটনা থেকে বড় ঘটনায় যেতে পারে। এ কারণে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং মিয়ানমারকে সতর্ক করতে হবে।